*আত্ম কথা……

ভাবনা গুলো ছড়িয়ে যাক সবার প্রাণে…

Tag Archives: মায়ের জন্য

মায়ের জন্য

আমার মা। আমার বাবার চেয়ে আমার মা আমাদের ভাই বোন দের প্রতি বেশি যত্নবান। যদিও আমাদের পরিবার অত বেশি বড় না। আমরা দুই ভাই আর সব ছোট আমার ছোট বোন। জীবনে বড় কিছু করার আশায় ছোট বেলা থেকেই বাড়ির বাহিরে থাকতে হয়েছে আমাকে। যখন ক্লাস থ্রি তে পড়তাম তখন থেকেই গ্রাম ছেড়ে মফস্বলে ফুফুর বাসায় থাকতাম। মাসে দুই বা তিন বার বাড়িতে যেতাম সারা দিন থেকে আবার বিকেলে ফিরে যেতাম।তখন মা কে অনুভব করতাম কি না সঠিক মনে নেই…তবে মনে পড়ে একদিন মায়ের কথা মনে পড়ায় একা একা কেঁদেছিলাম…কারন টা হল কোন একটা বইয়ে প্রশ্ন ছিল মা আমাদের কি যত্ন করে এই ধরনের…উত্তর ছিল…মা আমাদের গোছল করিয়ে দেয়…মাথার চুল আছড়িয়ে দেয়…ভাত খাইয়ে দেয়…ইত্যাদি ইত্যাদি…আর তার নিচে কিছু ছবি আঁকা ছিল এই সব বিষয়ের…তা দেখে আমার এত খারাপ লেগেছিল…শব্দ না করে আস্তে আস্তে কেঁদেছিলাম…যাতে কেউ যেন না জানে। আফসোস করতাম আহ্‌! আমার মা আমার সাথে থাকলে আমাকে এই সব করিয়ে দিতেন…এছাড়াও মাঝে মাঝে ছোট খাট বিষয়ে মায়ের কথা মনে পড়লে মন খারাপ হত…

আমি এখন বড় হয়ে গেছি, আগে মায়ের কাছ থেকে হয়ত ৩০ কি ৪০ মাইল দূরে থাকতাম এখন থাকি শত মাইল দূরে।

২০০৮ সালে বাড়ি থেকে খবর আসলো আম্মু কে হসপিটালে নেওয়া হল…কি জন্য নেওয়া হল বুঝতে পারলাম না…অফিসের কাজে ঢাকার বাহিরে ছিলাম। বাড়িতে যে ফোন করে একটা খবর যে নেব তার সুযোগ ও সময় পাই নাই কিন্তু ভিতরে ভিতরে ওয়ার্নিং বাজতে ছিল। ফোন করলাম আব্বু ধরল বলল পেটে ব্যাথা, কারন হল আম্মু পান আর জর্দা বেশি খায়। তারপর বলল এখন সুস্থ্য বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পরের দিন আম্মু কে ফোন দিয়ে বিষয় টা আরো ক্লিয়ার হলাম। পেটে নাকি পাথর হয়েছে ছোট একটা অপেরেশন করা লাগবে। আমি বললাম কইরা ফালান…অসুখ বিসুখ জমাইয়া কোনো লাভ নাই…। যাই হোক আমি ভেবেছিলাম আম্মু হয়ত একাই কাজ টা সেরে ফেলবে…কারো সহযোগীতা ছাড়াই…কারন আমার আম্মু খুব সাহসী খুব বুদ্ধিমান।
তাই আর এই বিষয়ে আমি আর নাক গলালাম না কারন আমি আম্মু আমাকে বলেছিল ৩ থেকে ৪ দিন এর মধ্যে অপেরেশন হয়ে সুস্থ্য হয়ে তিনি বাড়ি চলে যেতে পারবেন। তাই আমি সম্পুর্ন আম্মুর কথায় আশ্বাস করে চিন্তা মুক্ত হলাম। মাঝে মাঝে ফোন করে জিজ্ঞেস করতাম উনি বলত ওটা কোন সমস্যাই না…ডাক্তরে ওষুধ দিয়েছে নিয়মিত খেলে আর বেশি করে পানি খেলে তেমন কোন সমস্যাই হবে না। আর আমারও এই বিষয়ে তেমন কোন ধারনাই ছিল না। তারপরেও আমি আম্মুকে অনেক কথা বলতাম অপেরেশন টা করে ফেলেন, উনি বলত এই আগামী মাসে করে ফেলুম…এই ভাবে করতে করতে আসল ২০১০। আমার এক খালাতো বোন আছে উনি আবার ছোট খাট ডাক্তার ঈদে উনার সাথে দেখা হয়ে গেল। উনি আমারে বলল তুই খালামুনিরে অপেরেশন করাছ না ক্যন? তুই জানছ উনার পিত্তে পাথর হয়েছে…অপেরেশন না করলে কিন্তু পাথর গুলো বড় হয়ে অন্য কোন বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। পড়ে গেলাম চিন্তায়, এদিক সেদিক খবর নিলাম সবাই একই কথা তুই না থাকলে তোর মা একা একা কেমনে অপেরেশন করবে। বুজতে পারলাম আমি না থাকলে আম্মু অপেরেশন করবে না। যাই হোক আমার যত কাজ ই থাকুক না কেন, আম্মুর অপেরেশন টা না শেষ করে ঢাকায় ফিরুম না…এই শপথ নিলাম। তাই সিধান্ত নিলাম ২০১০ এর রমজানের পর অপেরেশন টা শেষ করুম ইনসাল্লাহ। সেই মোতাবেক কাজ শুরু করলাম । আমাদের জেলায় অনেক গুলো হসপিটাল আছে মান সব গুলোই এভারেজ, পরে ভাবলাম নাকি ঢাকায় করাব ? সেই সিধান্ত নিতে গেলাম পরে দেখা গেল ঢাকা থেকেই ডাক্তার এসে এখানেই অপেরেশন করার তাই অতিরিক্ত জামেলা না করাই ভাল তার উপর যে হসপিটালে আম্মু কে ভর্তি করাব সেই হসপিটালের মালিক আমাদের এলাকারই এবং দুঃসম্পর্কের আত্নীয় বলা চলে। যাই হোক সিধান্ত ফাইনাল প্রতি সাপ্তাহে ২ দিনের জন্য ডাক্তার এসে রুগি দেখে ও অপেরেশন করে…সে অনুসারে আম্মুকে অপেরেশন করা তারিখ পড়ল ১৯ অগাষ্ট ২০১০…। এর আগেও আমি আমার অনান্য আত্মীয় স্বজনদের অপরেশন এ আমি পরোক্ষ ভাবে জড়িত ছিলাম। কিন্তু আম্মুর অপেরেশন টাই আমার জীবনের প্রথম প্রতক্ষ ভাবে জড়িত থাকার অপেরেশন যা কিনা আমার আজীবন মনে থাকবে।

অপেরেশনের দিন আমার আম্মু তো কাদঁতে কাদঁতে শেষ যখন ওটি তে নেওয়ার প্রস্তুতি হচ্ছিল। আর আমি কি করুম বুঝতে পারছিনা। সারা দিন আম্মুর এই টেষ্ট ঐ টেষ্ট করে আমার পুরা শরীর ক্লান্ত। যাই হোক আম্মু ওটিতে ঢুকল আমি তো এখানে আল্লাহ্‌ খোদা কিছহু বাকী রাখি নাই…শুধু ডাকতে ডাকতে শেষ…আল্লাহ্‌, যেন সব কিছু সঠিক ভাবে হয়…আল্লাহ্‌…। ওটি রুম থেকে একজন বেরিয়ে এসে বলল আপনার আম্মার জন্য রক্ত রেডি রাখেন, যাই হোক মায়ের জন্য এক ব্যগ রক্ত দিলাম আর কি…সমস্যা নাই…তারপরেও যেন আমার মা সুস্থ্য থাকে…আল্লাহ্‌র কাছে সেই রাতে অন্য কোন দোয়া করি নাই…নিজের সব পাপ এর কথা মাথায় আসতো আর আল্লাহ্‌ কে বললাম তুমি এটার শাস্তি আমাকে অন্য কোন ভাবে দিও তারপরেও আমার মাকে ভালো করে তুলো, সুস্থ্য করে তুলো। কয়েক ঘন্টা পর ওটি থেকে একজন বেরিয়ে আমাকে ওটির পাশে একটা রুমে নিয়ে গিয়ে দেখাল আমার মায়ের পিত্ত থলি টা । ওটা কেটে ওটার ভিতর থেকে আমার চোখের সামনে ১১ টা পাথর, এটা দেখে আমি কিছুক্ষন হ্যাং হয়ে ছিলাম। আড়াই ঘন্টা পর আম্মু কে ওটি থেকে বের করা হল। প্যাথেডিন দেওয়া হচ্ছে…আমার তাজা তাজা রক্ত গুলো দেওয়া হচ্ছে…দুই জন ডাক্তার সব কিছু চেক করছে নার্স রা ও তো আছে…কোন কিছুর ই ঘাটতি নাই…আল্লাহ্‌ কে তো ডাকছি আর ডাকছি…তারপরেও আমার মনে শান্তি পাচ্ছি না…কারন আমার সামনে আমার শুয়ে আছে আমার মা দেখে মনে হয় তিনি অর্ধমৃত…ডাক্তার রা আমাকে বলল আপনার মায়ের পিত্তে ১১ টা পাথর পাওয়া গেছে। প্রথমে ল্যপরোস্কফি তে ট্রাই করার ইচ্ছা ছিল কিন্তু তাতে সফল হওয়ার সম্ভবনা কম ছিল। তাই কেটে করা হল। ইসাল্লাহ, তিনি খুব দ্রুত সুস্থ্য হয়ে উঠবেন। সেই রাত্রে আর কিসের, ঘুম কত রকম চিন্তা কাজ করে। নিজেকে অনেক কষ্ট করে নিয়ন্ত্রন করে আল্লাহ্‌ কে ডাকতে ডাকতে অনেক গুলো রাত পার করছি। হসপিটালে আম্মু সুস্থ্য হওয়া পর্যন্ত ছিলাম আর প্রায় রাত অল্প ঘুমিয়ে না ঘুমিয়ে কাটাতে হত। যখন দেখি আমার মা…কোনো কারনে ব্যথা পেলে উহু বা আহ করে উঠে তখন আমার কলিজা মনে হয় ছিড়ে পড়ে যাচ্ছে। আমি সহ্য করতে পারতাম না। শুধু আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করতাম।

যত দিন পর্যন্ত আম্মু স্বাভাবিক হয় নি তত টা দিন আমার রাত্রে ঘুম আসত না। ঘুম আসলেও ভেংগে যেতে মনে হত আম্মুর যেন কি হয়েছে…আম্মু মনে হয় আর স্বাভাবিক হতে পারবেনা…এছাড়াও কত কিছু ভাবতাম…আর আল্লাহ্‌র নাম ডাকতাম…একদিন আম্মুর রাত্রে প্রচুর ব্যাথা উঠল আমি কেবিন থেকে রেরিয়ে দেখালাম নার্স সব গুলা ঘুমে…অনেক কষ্টে ডেকে তুতলাম একজন কে ইঞ্জেকশন দিল…ব্যাথ্যা কমল…সকাল বেলা আম্মু কয়…আমার পোলা না থাকলে আমারে রাত্রে কে নার্স ডেকে দিত…

যদিও হসপিটালে আমার দুই জন নানু সবসময় থাকত। তারা সারাদিন নামাজ পড়ে আম্মুর জন্য দোয়া করত…এছাড়া আমার বড় খালাও কয়েক রাত হসপিটালে ছিল…তাদের দিকে আমি তেমন কোন মনোযোগ দিতে পারি নাই এখন তা মনে হচ্ছে। তারা সব সময় ফ্লোরে ঘুমাত আর আমারে উপরে ঘুমাতে দিত। খাওয়া দাওয়া তেমন কোন সমস্যাই হত না। প্রতিদিন আত্মীয় স্বজন রা ফোন করে সিডিউল নিয়ে নিত কখন কে খাওয়াবে…কি কি খাওয়াবে। এক্ষেত্রে যাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করলে আমার আমার আপরাধ হবে তারা হলেন, আমার নানু যিনি আম্মুর দিকে আমার চাইতে বেশি নজর দিতেন। নানুর ছোট বোন (আমার আরেক টা নানু ) উনি সারাক্ষন ঈবাদত দিয়ে ব্যস্ত থাকতেন এছাড়াও আমার সাথে কথা বলে আমার টেনশন টা উনি কমাতে চেষ্টা করতেন। আমার বড় খালা, উনি এমনিতেই অসুস্থ্য তাপরেও উনি আম্মুর জন্য অনেক কিছু করেছেন আম্মুকে শোয়া থেকে উঠাতেন বসাতেন। আমার ছোট খালা, খাওয়া দাওয়ার দায়িত্বে ছিলেন দুপুরে আসতেন সন্ধ্যায় চলে যেতেন কিন্তু আমার মেজাজ খারাপ হত উনার দুইটা পিচ্ছিরে…যদিও আদর করতাম কিন্তু ওরা এখানে এসি চিল্লা পাল্লা করত এবং তাতে আম্মুর ঘুমের সমস্যা হত। আমার ছোট জেঠি আমি দিনের বেলা উনার বাসা গিয়ে একটু রিলাক্স হয়ে আসতাম এছাড়া ও উনি আমাদের জন্য খাওয়াও পাঠিয়েছিলেন। আমার ছোট ফুফু…আম্মুর জন্য বেশী করে দোয়া করেছিল তিনিও উনি আমাদের জন্য খাওয়াও পাঠিয়েছিলেন। এছাড়াও আমাদের অনেক আত্মীয় স্বজন আম্মুকে হসপিটালে দেখতে এসেছিলেন…বিভিন্ন ফল ও রসদ নিয়ে যা আমি ব্যক্তিগত ভাবে এসব খুবই অপছন্দ করি। একজন আসলে অন্তত তার সাথে ১ ঘন্টা আজারিয়া আলোচনা করতে হয় যা কিনা পরেও করা যায় এবং এই আলোচনা রুগির কোনো ভাল হয় না বরং ক্ষতিই হয়, তারপরেও সরাসরি তো আর না করতে পারি না। তাই কম কথা বলতে চেষ্টা করতাম। আমি জানি এতে অনেকেই মনে কষ্ট পেতে পারেন কিন্তু তাদের কে দুঃখিত বলা ছাড়া আমার আর কিছুই বলার থাকবে না।

আমার মেজ জেঠি প্রতিদিন রাত্রে ফোন করে আপডেট জানতেন কারন তিনি ঢাকায় থাকেন। এছাড়াও আমার আত্নীয় স্বজন যারা অপেরেশনের খবর শুনেছিল তারা ফোন করেছিল, তাদের ফোন ধরতে ধরতে আমার জান শেষ। যাই হোক তাদের কাছেও আমি দুঃখিত। আমার স্কুলের কলেজের অনেক বন্ধুও এসেছিল বিভিন্ন রসদ নিয়ে যাই হোক তারা আমাকে কে যতটুকু সম্ভব সাহস যুগিয়েছিল। অনলাইনের অনেকেই ফোন করেছিল তবে এক্ষেত্রে যার কথা সবার আগে বলব তিনি হল রংমহলের সমন্বক জিয়া ভাই, তিনি তার ফোরামে আমার মায়ের জন্য আমার পক্ষ হয়ে টপিক খুলেছিল যাতে করে অনেকেই দূর থেকে আমার মায়ের জন্য দোয়া করেছিল তাদের প্রতিও আমি সমান ভাবে কৃতজ্ঞ । সামি ভাই ও তার (আজারিয়া কামে) ব্যস্ততার মাঝে ফোন করেছিল কিন্তু ধরতে পারি নাই। অনেকেই ফোন করেছিল কিন্তু মোবাইল সুইচঅফ করে রেখেছিলাম বলে ধরতে পারি নাই কিন্তু পরে মিস কল এলার্ট তা মনে করে দিয়েছিল।

এত সব কিছুর পরে আমার একটা কথাই মনে হয় মানুষ মানুষের জন্য…যাদের নাম উল্লেখ্য করেছিলাম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে । তারা ইচ্ছে করলে এসব নাও করতে পারত কারন তাতে কোন তার লাভ বা ক্ষতি হত না, তা হলে কেন করেছিল…তা হল আত্মিক বন্ধন…মানুষের প্রতি মানুষের আন্তরিকতার বহ্নি প্রকাশ…ইত্যাদি। বর্তমানে আমার মা সুস্থ্য উনি স্বাভাবিক ভাবে সব কাজ করতে পারেন। ইনসাল্লাহ যত দিন তিনি বেঁচে থাকবেন তত দিন ভাল ও সুস্থ্য ভাবে বেঁচে থাকবে। সবাই সবার অবস্থান থেকে যত টুকু সম্ভব সাপোর্ট দিয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশে মানুষ রূপি এমন কিছু সমপ্রদায় আছে যাদের ভিতের শুধু হিংসা, লোভ, অন্যকে শোষন করে নিজের স্বার্থ হাসিল করার প্রবনতা সব সময় কাজ করে, তাদের কে সৃষ্টি কর্তা এই মানবীয় গুন গুলো দেয় নাই। সৃষ্টি কর্তা এই সব সমপ্রদায় কে হেদায়েত দান করুক, আমিন।
ভালোবাসি আমার মা কে, ভালোবাসি বাংলাদেশ কে।